এই ঘটনাটা শুরু থেকে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সাত বছর পেছনে। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট নবম শ্রেণীর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার দিন এক বন্ধুর কোনও উত্তর দেখতে গিয়ে এক শিক্ষকের চোখে ধরা পড়ে যায় সায়ন। সে সময় রাগের মাথায় শিক্ষক বলে বসেন, ‘এইভাবে পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই! বেরিয়ে যাও এক্ষুনি।’ রাগ হয় সায়নের। সায়ন সেই যে স্কুল থেকে বেরিয়েছিল, আর বাড়িও ঢোকেনি।

সায়নদের আসল বাড়ি পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি জেলার দুয়ারসিনি পাহাড়ের কোলে ঝাড়খন্ড সীমান্তের সুইসা স্টেশনের পাশে টুনটুড়ি গ্রামে। তবে, বাবা মানিক ঘোষ কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকতেন বলেই একমাত্র ছেলে সায়নকে নিয়ে চন্দ্রকোণারোডের বিলা গ্রামে নিজের বাপের বাড়িতে থাকতেন সায়নের মা নিতা দেবী। ছোট থেকেই সায়ন শান্ত এবং চুপচাপ বলেই জানান পরিবারের লোকজন থেকে প্রতিবেশীরা। এছাড়া খুব আত্মসম্মান কেন্দ্রিক। সেই কারণেই শিক্ষকের সামান্য ‘ধমক’ সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছাড়ে। বলা ভালো, এলাকা ছেড়ে বিদায় নেয় সে।

নিখোঁজের রাতেই চন্দ্রকোণারোড পুলিশ ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সায়নের মা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি সায়নকে। বাড়িতে সায়নের যে আধার কার্ড ছিল, তার সূত্র ধরে পুলিশ সায়নের বর্তমান ঠিকানা জানার চেষ্টা করেছেন। শেষমেশ তাতেই অবশ্য সাফল্য আসে। গত ১৩ আগস্ট পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে সায়নের মা জানান, সায়ন আধার কার্ডে কিছু একটা আপডেট করেছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।

তার পরেই দ্বিগুণ তৎপরতায় উদ্ধারকাজে নামে পুলিশ। তদন্তকারী অফিসার তথা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রাজেশ পাড়ুয়া ওই আধার কার্ডের নম্বর ধরে জানতে পারেন, এই আপডেটের কাজটি হয়েছে ওড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের একটি এলাকা থেকে। এর পরেই গত ২৫ আগস্ট একটি টিম তৈরি করে ভুবনেশ্বরে পাঠানো হয়। সেখানেই খোঁজ মেলে সায়নের। সায়ন বর্তমানে একটি অনলাইন পরিবহণ সংস্থার গাড়ি চালায়। সেই সংস্থার কর্ণধারকে ধরেই ওর খোঁজ মেলে। এই অভিযানে ওড়িষ্যা পুলিশও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। 

জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার জানান, চন্দ্রকোণারোড পুলিশ বিট হাউসের আইসি রাজেশ পাড়ুয়ার নেতৃত্বে আমাদের ওই টিম ৬ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া যুবককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। 

এদিকে, একমাত্র সন্তানকে ফিরে পেয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি সায়নের মা নিতাদেবী। সায়নের দিদিমা উমা দেবী বলেন, ‘কোনওদিন ভাবিনি, নাতিকে আর ফিরে পাব! ওর দাদু তো নাতির অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই একদিন চোখ বুজল। পুলিশকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই। ওঁরা অসাধ্য সাধন করেছে।’

কিন্তু কী ভাবে ওড়িষ্যা পৌঁছল সায়ন? চন্দ্রকোণারোড থেকে সায়ন প্রথমে ট্রেন ধরে প্রথমে খড়গপুর, পরে সেখান থেকে কটক, তারপর পুরী চলে যান। পরে পুরী থেকে ফের ফিরে আসার জন্য ট্রেন ধরেন। কিন্তু সেখান থেকে পৌঁছে যান বেঙ্গালুরু। পুনরায় ভুবনেশ্বরে ফিরে এসে জীবন অন্যদিকে মোড় নেয়। শ্রীকান্ত দাস নামে জনৈক ব্যক্তি সায়নকে বাড়িতে আশ্রয় দেন। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। ওঁর বাড়িতে থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সায়ন। সম্প্রতি সায়ন ভুবনেশ্বরে নিজের টাকায় জমিও কিনেছিলেন বাড়ি করবেন বলে। সেই জন্যই আধার কার্ডে থাকা ঠিকানাও পরিবর্তন করেছিল সায়ন। আর সেই সূত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় সায়নকে। ‌সায়ন যে অসৎ চক্রে না পড়ে সঠিক পথে জীবনকে অতিবাহিত করতে শুরু করেছিলেন সেই জন্য ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ জানান সায়ানের মা নিতাদেবী।